জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝে পূর্ব পশ্চিম মুখী একটি ভাসমান সেতু । সেতুটির উত্তর পাশে সম্পূর্ণ টগবগে কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে । দক্ষিণ পাশে কিছুটা অংশে কচুরিপানা নেই, তারপর আবার কচুরিপানার দখল দারিত্ব । তবে এই ফাঁকা অংশটুকুতেও যেকোন সময় কচুরিপানা বিস্তার করবে বলে অনুমান করা যায় ।
স্থানীয় পৌরবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই নদটিতে গত কয়েক দশক দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ প্রজেক্ট আকারে প্রতি বছর কোটি টাকার উপরে মাছ চাষ করেছে । বর্তমানে অযত্নে-অবহেলায় কোটি টাকার জলজ সম্পদ নষ্ট হচ্ছে । নদের কিনারে গত বছর যেখানে ধান চাষ করা হয়েছে, সেখানে এখন কচুরিপানা । ধান চাষের সুযোগ নেই । নদীতে জাল ফেলার সুযোগ নেই । প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভাসমান সেতুটি ভেঙে যায় । তখন নদে পানি থাকলেও কচুরিপানার কারণে নৌকা চালানো কষ্টকর হয় পরে । ব্রহ্মপুত্রের কচুরিপানা গুলো অপসারণ করা জরুরী । এতে রক্ষা হবে নদের জলধারা ও জলজ বাস্তুসংস্থান । নদটিতে বৃদ্ধি পাবে দেশীয় মাছের প্রজনন।
ইতিহাস স্বাক্ষী, কচুরিপানা বাংলায় এসেছিলো অভিশাপ হয়ে । ফেলেছিলো মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব । বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া ও জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলা পিডিয়ার তথ্য বলছে, কচুরিপানা পচে পানির নিচে বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায় । এতে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় । পানির নিচের জলজ উদ্ভিদ মরতে শুরু করে । সেই সাথে প্রচুর মাছ মরে যায় । মানুষের জন্যও এই পানি ব্যবহার করা অনিরাপদ । কচুরিপানা দ্রুত বর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ । ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে । উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একটি মাত্র উদ্ভিত পঞ্চাশ দিনে তিন হাজারের বেশি সংখ্যায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে । এটি প্রচুর পরিমানে বীজ তৈরি করে । কচুরিপানার বীজ ৩০ বছর পরেও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে । রাতারাতি বংশ বিস্তার করে প্রায় ২ সপ্তাহে দ্বিগুন হয় । কচুরিপানা মশার বাসস্থান সৃষ্টি করে । সেই সাথে ম্যালেরিয়া ও কলেরা রোগের সাথে পরোক্ষ ভাবে জড়িত বলেও মন্তব্য করেছেন তৎকালীন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষকগণ ।
১৮শ শতকের শেষভাগে জর্জ মরগ্যান নামের এক পাট ব্যাবসায়ী ভারত উপমহাদেশে কচুরিপানা নিয়ে আসেন । উদ্ভিদটি দ্রুত বাড়ার কারনে ১৯২০ সালে বাংলার প্রতিটি নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর- জলাশয়ে ছেয়ে যায় । ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা নির্মূল আইন প্রণীত হয় । ১৯৩৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলো কচুরিপানা মুক্ত করার অঙ্গিকার দেয় । ১৯৩৯ সালে মেম্বার অব বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ও কলকাতার মেয়র শেরে-ই-বাংলা এ.কে.ফজলুল হক নির্বাচিত হয়ে সে বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাংলায় ‘ কচুরিপানা সপ্তাহ’ পালন করেন ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল তার ‘ফাইটিং উইথ আ উইড: ওয়াটার হায়াসিন্থ অ্যান্ড দ্য স্টেট ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে লিখেছেন, কচুরিপানার এসব নাস্তানাবুদ পরিস্থিতির কারণে তখনকার গণমাধ্যমে কচুরিপানাকে ‘বিউটিফুল ব্লু ডেভিল’ এবং ‘বেঙ্গল টেরর’ বলে আখ্যায়িত করেছিলো ।
দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে সাবেক মেয়র শেখ মোহাম্মদ নুরুন্নবী অপু সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা খরচ করে কচুরিপানা অপসারণ করেছিলো । আবারো নদটিতে কচুরিপানা ছেয়ে গেছে । চলতি বছর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কচুরিপানা অপসারণ করার জন্য ৩ লক্ষ টাকা ব্যায়ের একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছিলো । কিন্তু পরিচ্ছন্ন শ্রমীকেরা বলেন, ৭-৮ লক্ষ টাকার বাজেট লাগবে । পৌরসভায় পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় পৌরসভা কর্তৃপক্ষ দ্বারা এই মুহুর্তে কচুরিপানা অপসারণ সম্ভব নয় বলেও জানা যায়।
এ বিষয়ে কথা হয় উপজেলা বন বিভাগ কর্মকর্তা মো. রাশেদ ইবনে সিরাজ এঁর সাথে। তিনি বলেন, ‘সূর্য রশ্নির মাধ্যমে নদে যে খাদ্য তৈরি হয় , কচুরিপানার কারনে তা ব্যহত হচ্ছে । পানি ঘুলা থাকছে, পানি দূষিত হচ্ছে । সঠিকভাবে জলজ বাস্তুসংস্থান হচ্ছেনা । ’
উপজেলা মৎস কর্মকতা মো. শফিউল আলম বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদটি মরে গেছে । উন্মুক্ত জলাশয়ে পরিণত হয়েছে । প্রায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে কেবল নদের চিহ্ন রয়েছে । সেখানে কচুরিপানার যে দখল দারিত্ব দেখা যাচ্ছে তাতে দ্রুত অপসারণ করা দরকার । কচুরিপানা দ্রুত বর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ । নয়তো ভবিষ্যতে বেগ পোহাতে হবে ।
জামালপুর থেকে জাকিরুল ইসলাম বাবু